সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন
সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন :
মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মানস কান্তি বিশ্বাস
বিষয়বস্তুঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস- মুহম্মদ জাফর ইকবাল)
জ্ঞানমূলক দক্ষতা
যখনই প্রশ্ন করা হয় তখন সেটি করা হয় কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু থেকে। সৃজনশীল প্রশ্নের বেলাতেও তাই। আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীদের বিষয়বস্তু হচ্ছে তাদের পাঠ্য বই। কাজেই যখনই আমরা সৃজনশীল প্রশ্ন করতে চাই তখন সবার আগে বিষয়বস্তুটা ঠিক করে নিতে হয়। সৃজনশীল প্রশ্নের জানা, বুঝা, ব্যবহার করা আর উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্নগুলো আসতে হবে তাদের সেই পাঠ্য বিষয়বস্তু (content) থেকে। যারা এই লেখাটি পড়ছে তারা সবাই যে প্রত্যেক শ্রেণির প্রত্যেকটা বই খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েছেন তা নয়, তাই উদাহরণ দেওয়ার জন্যে আমরা এমন একটা বিষয় বেছে নিই যেটা কোনো পাঠ্য বই নয় কিন্তু একটা সুনির্দিষ্ঠ বিষয়বস্তু এবং যেটা মোটামুটি সবাই জানে। সবচেয়ে সহজ আর সুন্দর বিষয়বস্তু হতে পারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রথমে জ্ঞানমূলক কয়েকটা প্রশ্ন করা যাক। এই প্রশ্নগুলো করা সবচেয়ে সহজ এবং কেউ যদি তার বিষয়বস্তুটি ঝাড়া মুখস্থ করে ফেলে তাহলে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারবে। মুখস্থ (মনে রাখা) করতে পারা একটি অতি প্রয়োজনীয় দক্ষতা, এবং সম্ভবত সবচেয়ে নিচুস্তরের দক্ষতা। খুব দুঃখের সাথে বলতে হয় আমাদের দেশের যে নানা ধরণের টেস্ট হয় সবখানেই (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) শুধুমাত্র এই ধরণের প্রশ্ন থাকে তাই সত্যিকার ভাবে একজনের সঠিক মূল্যায়ন হয় না, সে কতটুকু মুখস্থ করতে পারে সেটা যাচাই করা হয়। এই ধরণের প্রশ্নের কারণে গাইড বই রমরমা ব্যবসা করতে পারে।
যাই হোক ভূমিকা না বাড়িয়ে আমরা কিছু জ্ঞানমূলক প্রশ্ন করে ফেলি:
১। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্ভরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ কতোগুলো সিট পেয়েছিল?
২। অপারেশন সার্চ লাইট বলতে তুমি কী বুঝ?
৩। মুক্তিযুদ্ধে কতজন মারা গিয়েছিল বলে বাংলাদেশে অনুমান করা হয়ে থাকে?
৪। মুক্তিযুদ্ধে এই দেশের কতজন শরণার্থী পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল?
৫। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন্ কো্ন দেশ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল?
আমরা ইচ্ছে করলে এরকম আরো প্রশ্ন করতে পারি কিন্তু আপাতত এখানে থেমে যাই। কেউ কেউ হয়তো একটু অস্বস্তি বোধ করতে পারেন সে দিন তারিখ বা সেক্টর কমান্ডারদের নাম বা পক্ষের দেশ বিপক্ষের দেশগুলোর নাম চট করে মনে পড়ছে না! তাতে অস্বস্তি বোধ করার কোনো কারণ নেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার আগে বিষয়বস্তুটি খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ার কথা- শুধুমাত্র তাহলেই উত্তর দেয়া সম্ভব। যদি কেউ বিষয়বস্তুটি জানতে চায় ইচ্ছে করলে ওয়েবসাইট থেকে ২২ পৃষ্ঠার ‘‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’’ বইটা পড়ে ফেলতে পারে। এই প্রশ্নগুলো এই ছোট পুস্তিকার বিষয়বস্তুর মাঝে সীমাবদ্ধ রাখা হবে।
প্রশ্ন বিশ্লেষণ
এবারে আমরা একটা একটা করে প্রশ্নগুলো দেখি-
১ নং প্রশ্নটি ঠিক আছে, বিষয়বস্তুটা সঠিক ভাবে পড়ে থাকলে যে কেউ উত্তরে বলতে পারবে নির্বাচনে ১৬২টি আসনের ভেতর ১৬০টি আসন পেয়েছিল।
২ নং প্রশ্নটিতে আসলে সমস্যা আছে, এখানে জিজ্ঞেস করা হয়েছে অপারেশন সার্চ লাইট বলতে ‘‘তুমি কী বুঝ?’’ যে উত্তর দিচ্ছে সে যদি মনে করে নদীতে লঞ্চ যাবার সময় সে বিশাল লাইট দিয়ে লঞ্চ চারিদিকে আলো ফেলতে ফেলতে যায় তার ‘‘অপারেশান’’ বা কার্যপদ্ধতি হচ্ছে অপারেশনে সার্চ লাইট এবং প্রশ্নের উত্তরে সে সেটাই লিখে দিয়ে আসে তাহলে আমাদের কিছু করার নেই, তার উত্তরটি আমাদের শুদ্ধ বলে ধরে নিতে হবে!
আমরা আসলে এই উত্তর চাই না তাই প্রশ্নটি ঠিক ভাবে করতে হবে। আমাদের জিজ্ঞেস করতে হবে,
‘‘অপারেশন সার্চ লাইট বলতে কী বুঝানো হয়?’’ প্রশ্নটিকে আরো সুনির্দিষ্ট (সফল প্রশ্নের গুরুত্বপূর্ণ গুণ) করার জন্য জিজ্ঞেস করা যেতে পারে ‘‘ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অপারেশন সার্চ লাইট বলতে কী বুঝানো হয়?’’।
এবারে আসলে অন্য কোনো উত্তর দেয়া সম্ভব নয় আমাদের বিষয়বস্তুতে পরিস্কার করে লেখা আছে সার্চ লাইট হচ্ছে পাকিস্তান মিলিটারীর তৈরী করা একাত্তরের গণহত্যার নীল নকশা। যে উত্তর দিচ্ছে তাকে সেটাই লিখতে হবে। জ্ঞানমূলক প্রশ্নে আসলে সরাসরি খাঁটি তথ্যটুকু লেখা হয় এখানে নিজের কিছু যোগ করার সুযোগ দেয়া হয় না। হতাশ হবার কিছু নেই নিজের কেরদানী দেখার সুযোগ অন্য ধরনের প্রশ্নগুলোতে আছে।
৩ নং ও ৪ নং প্রশ্নে কোনো সমস্যা নেই, বিষয়স্তুটা জানা থাকলেই ঝটপট এর উত্তর দিতে পারবে। রাজাকার টাইপের মানুষেরা প্রমান করার চেষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধে আসলে এতো বেশী মানুষ মারা যায় নি- এই প্রশ্নের উত্তরে তারাও সুবিধা করতে পারবে না। তাদেরকেও ত্রিশ লক্ষ লিখতেই হবে কারণ বাংলাদেশে আমরা এই সংখ্যাটাই গ্রহণ করেছি।
৫ নং প্রশ্নে আসলে একটা ছোট সমস্যা আছে।
এই প্রশ্নের উত্তরে ১ মার্ক দেয়ার কথা- হয় পুরো ১ পাবে না হয় শূণ্য পাবে! কাজেই কেউ যদি পুরো উত্তরটুকু না লিখে তাহলে তাকে মার্ক দেয়া নিয়ে সমস্যা হতে পারে।
সমস্যাটা মেটানোর জন্য আমরা অন্যভাবে চেষ্ঠা করতে পারি ‘‘মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন্ গুরুত্বপূর্ন দেশটি বাংলাদেশের পক্ষে (কিংবা বিপক্ষে) ছিল?’’
আমাদের মনে হতে পারে সমস্যার সমাধান হয়েছে, আসলে সমাধান হয়নি। আমরা নির্ভুলভাবে তথ্য দিতে পারি কিন্তু তথ্যটুকু একজন কীভাবে গ্রহণ করবে সেখানে আমাদের কোনো হাত নেই।
একজন মনে করতে পারে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পক্ষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন দেশ ভারত কারণ তারা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে পাকিস্তান সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যৌথ বাহিনী হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে যুদ্ধ করেছে।
আবার অন্য কেউ মনে করতে পারে যে ভারত নয় মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পাশের সবচেয়ে গুরুত্বত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন কারণ শেষ যুদ্ধ চলাকালীন সময় জাতিসংঘে বারবার ভেটো দিয়ে আমেরিকার যুদ্ধ বিরতির চেষ্টা বানচাল করে দিয়েছে- আমেরিকা যখন তার বঙ্গোপসাগরে নৌ বহর পাঠিয়ে দিয়েছিল তখন তারাও নিউক্লিয়ার ক্ষমতাধারী যুদ্ধ জাহাজ এই এলাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।
কাজেই যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তি দেয়ার সুযোগ রয়েছে বলে এটি অন্য স্তরের চমৎকার প্রশ্ন হতে পারে কিন্তু সঠিক জ্ঞানমূলক প্রশ্ন নয়। কাজেই আমরা সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে প্রশ্নগুলোকে সঠিক জ্ঞানমূলক প্রশ্ন করে ফেলব, আমরা লিখব :
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে (কিংবা বিপক্ষে) ছিল এরকম একটি দেশের নাম লিখ। প্রশ্নগুলোর মাঝে বৈচিত্র আনার জন্যে বাংলাদেশের পক্ষে না লিখে ‘‘পাকিস্তান পক্ষে’’ এই কথাটাও লিখতে পারি।
কাজেই এবার আমরা নূতন করে আমাদের ৫টি জ্ঞানমূলক প্রশ্ন লিখে ফেলি:
১। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্ভরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কতোগুলো সিট পেয়েছিল?
২। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অপারেশন সার্চ লাইট বলতে কী বোঝানো হয়?
৩। মুক্তিযুদ্ধে কতজন মারা গিয়েছিল বলে বাংলাদেশে অনুমান করা হয়ে থাকে?
৪। মুক্তিযুদ্ধে এই দেশের কতজন শরণার্থী পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল?
৫। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে ছিল এরকম একটি দেশের নাম লিখ।
আপাতত আমরা ধরে নেই যে কোনো বিষয়বস্তু থাকলে সেখান থেকে কীভাবে জ্ঞানমূলক প্রশ্ন করা যায় আমরা সেটা মোটামুটি শিখে গেছি। যারা একটু খুটিয়ে খুটিয়ে উদাহরণগুলো দেখেছে তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছে এই জ্ঞানমূলক প্রশ্নগুলো সাধারণত কী, কখন, কার, কে- এ ধরণের প্রশ্নবোধক শব্দ দিয়ে তৈরী করা হয়। বলাই বাহুল্য এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্যে বিষয়বস্তু খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তে হবে। যদি উত্তর জানা না থাকে শুধুমাত্র চিন্তা করে করে কেউ এর উত্তর বের করতে পারবে না!
এখানে আরেকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, কেউ যেন মনে না করে জ্ঞানমূলক (recall) ধরণের প্রশ্নের নম্বর মাত্র ১, মোট নম্বরের মাত্র ১০% কাজেই এটাকে ছেড়ে দিয়ে বাকী ৯০% মার্কস দিয়ে কেল্লা ফতে করে দিব! কারণ আমরা যখন একটু পরেই অন্য স্তরগুলো দেখব তখন আবিস্কার করব প্রত্যেকটা স্তরেই কিন্তু একটুখানি করে জ্ঞানমূলক অংশ থাকে- কাজেই যদি বিষয়বস্তু (অর্থাৎ পুরো পাঠ্য বই!) না পড়ে শুধুমাত্র ‘‘সৃজনশীল’’ হয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। অন্যভাবে বলা যায় কেউ যদি পাঠ্য বইয়ের কিছু না বুঝে পুরোটা মুখস্থ করে ফেলে তাহলে সব স্তর থেকে একটু একটু করে মার্কস পেয়ে ৪০% মার্কস পেয়ে টেনে টুনে পাশ করে ফেলবে! এর বেশী সে কিছুই পাবে না- কাজেই সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে শুধু পড়লে বা মুখস্থ করলে হয় না, বিষয়টা বুঝতে হয়।
সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করার একটা মূল কারণ কিন্তু মূল্যায়নে শৃঙ্খলা নিয়ে আসা। সৃজনশীল প্রশ্নের বড় শক্তিটি হল শিক্ষার্থীর সত্যিকার দক্ষতা যাচাই করার ক্ষমতা যা এর কাঠামোর মধ্যেই রয়েছে। শুধু প্রয়োজন সঠিকভাবে প্রশ্নটি তৈরী করা।
সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন
সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন
সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন
সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন
সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন
সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন
shikhon.org
সৃজনশীল প্রশ্ন
সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন
সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন
সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন
সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন
শিখন সাইট ব্যবহার