অনুধাবন মূলক দক্ষতা

সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন

সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন সম্পর্কে কিছু কথা:

মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মানস কান্তি বিশ্বাস

অনুধাবন

অনুধাবন বা বুঝতে পারা বিষয়টি একটু গোড়া থেকে দেখা যাক। মনে রাখতে পারার মত বুঝা বা বুঝতে পারা একটি দক্ষতা, তবে এটি অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরের দক্ষতা। বলা হয়ে থাকে সৃজনশীল হয়ে উঠার প্রথম ধাপ হল বুঝতে পারার দক্ষতা। মূলত কারো জানা কোন তথ্য বা অভিজ্ঞতার সাথে নতুন কোন তথ্য বা অভিজ্ঞতা মিলিয়ে নিতে পারার দক্ষতাই হল বুঝা বা অনুধাবন।

পাঠের সুবিধার জন্য এর পর থেকে আমরা অনুধাবন শব্দের বদলে বুঝা শব্দটি ব্যবহার করব। নিচের উদাহরণটি বিবেচনা করা যাক:

১৯৭৭-৭৮ সালের কোন এক সময়, রাখাল গ্রাম থেকে শহরে প্রথমবার এসেছে। সাথে তার ছোট ভাই। যে বাড়িতে তারা থাকছে রাতে সেখানে ঘরের দেয়ালে বাতি জ্বলতে দেখে ছোটভাই রাখালকে জিজ্ঞেস করল দাদা হ্যারিকেনটা যে জ্বলছে তাতে তেল আসছে কোথা থেকে। রাখাল খানিকটা ভেবে উত্তর দিল আরে গাধা হ্যারিকেনের পিছন থেকে যে লাল রশিটা আসছে সেইটে দিয়ে।

এবার বিশ্লেষণ করা যাক-

ছোটভাই এর জানা তথ্য: রাতে আলোর উৎস- হ্যারিকেন অথবা কুপি, হ্যারিকেনে আলো গোলাকার কাচ ঢাকা অংশ থেকে আসে।

নতুন পরিস্থতি: গোলাকার কিছু একটা থেকে আলো আসছে (মিল)-  এটি কোন প্রকার হ্যারিকেন।

জানা তথ্য: হ্যারিকেনে তেল রাখার ব্যবস্থা থাকে এখানে নেই (অমিল)- তাই প্রশ্নঃ তেল আসছে কোথা থেকে?

রাখালের জানা তথ্য: হ্যারিকেন থেকে আলো পেতে অবশ্যই কোন না কোন ভাবে তেলের যোগান লাগবে।

নতুন পরিস্থিতিতে বাল্বের নিচ দিয়ে লাল রশি (তার) ই সম্ভবত একমাত্র পথ।

আমরা সবাই জানি আমাদের দেশে দীর্ঘকাল লেখাপড়া মানেই ছিল মুখস্থ করা। ছাত্রছাত্রীরা সবকিছু মুখস্থ করে ফেলতো। পরীক্ষার সময় মুখস্থ করা জিনিস সবকিছু ওগলে দিত। যে যত ভালো মুখস্থ করতে পারত পরীক্ষায় তত ভালো মার্কস আসত। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে প্রথমবার সেই পদ্ধতিটা পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রশ্নের এই স্তরে একজন ছাত্র বা ছাত্রী মুখস্থ করে উত্তরটা দিতে পারবে না। এই স্তরের প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে বিষয়টা বুঝতে হবে। কাজেই প্রশ্নটা করতে হবে ঠিক যেভাবে ছাত্র বা ছাত্রী বিষয়টা বুঝেছে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেন সেটা বোঝা যায়। প্রশ্ন করার সময় মনে রাখতে হবে এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে বিষয়বস্তুর কোন তথ্য বা বিষয়কে ব্যবহার করতে হতে পারে কিন্তু উত্তরটা দিতে হবে ছাত্র বা ছাত্রীর নিজেকে। প্রশ্নের উত্তরটা যদি পাঠ্য বিষয়টাতে খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে কিন্তু এটা ‘বুঝা’ বা ‘অনুধাবনের’ প্রশ্ন হবে না। এটা হয়ে যাবে ‘জানা’ বা জ্ঞাননমূলক প্রশ্ন।

‘অনুধাবন’ বা ‘বুঝা’ শব্দ থেকে বোঝা যাচ্ছে এই ধরনের প্রশ্নগুলো করা হয় একজন বিষয়বস্তুটা পড়ে সেটা বুঝেছে কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্য। এই ধরনের প্রশ্নে দুটি অংশ থাকে-

১। একটি তথ্য যা বিষয়বস্তুতে আছে।

২। এই তথ্যটির সাথে কোন তথ্য, অভিজ্ঞতা বা ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক (মিল, আমিল নির্ভরশীলতা ইত্যাদি)

সাধারনত একটি অনুধাবন মূলক প্রশ্নের উত্তরে এক ধরনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়।

এই প্রশ্নের ধরনগুলো বোঝার জন্য আমরা প্রথমে কিছু অনুধাবনমূলক প্রশ্ন করে ফেলবো:

  1. মুক্তিযুদ্ধকে কেন কেউ পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দুই টুকরো করার সংগ্রাম বলতে পারে না?
  2. কেমন করে পাকিস্তান মিলিটারী তার ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেছিল?
  3. বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন কেন পুরো দেশকে পুরোপুরি অচল করে দিতে পেরেছিল?
  4. ৭ই মার্চকে কেন স্বাধীনতা দিবস হিসেবে বিবেচনা করা হয় না?
  5. পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ শুরু করার পূর্বশর্ত কি ছিল?

প্রশ্ন বিশ্লেষণ

এবারে আমরা একটা একটা করে প্রশ্নগুলো দেখি- এবং প্রশ্নের মধ্যে ১ ও ২ অংশ সঠিকভাবে উপস্থিত কিনা তা যাচাই করি।

১নং প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে একজনকে জানতে হবে নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রায় সবগুলো সিট পেয়েছিল এবং তাদেরই সরকার গঠন করার কথা (তথ্য)। কাজেই তাদেরকে সরকার গঠন করতে না দিয়ে উল্টো গণহত্যা শুরু করলে (উদ্ভুত পরিস্থিতি) এই দেশের মানুষের আত্মরক্ষার (আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা) জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অধিকার আছে। কাজেই এটা কোনো কারণ ছাড়া দেশ ভাগের যুদ্ধ নয়, এটা মুক্তিযুদ্ধ। কাজেই প্রশ্নটা ঠিক আছে, বুঝা বা অনুধাবন করার প্রশ্ন হয়েছে।

- তথ্য ও পরিস্থিতি অনুযায়ী অভিজ্ঞতার মধ্যে সম্পর্ককরণ

 

২নং প্রশ্ন পড়ে মনে হয় এটা অনুধাবনমূলক প্রশ্ন হয়েছে। কিন্তু আসলে প্রশ্ন হয়নি। কারণ পাকিস্তান মিলিটারী কিভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল সেটা স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে। কাজেই এটা বোঝার বিষয় নয়, বিষয়বস্তু পড়ে জানার বিষয়।

 

৩ নং প্রশ্নটি অনুধাবনমূলক প্রশ্ন কারণ এর উত্তর দিতে হলে একজনকে জানতে হবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬০/১৬২ সিট পেয়েছিল (তথ্য)। বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস্যরকম জনপ্রিয়তার কারনে এই দেশের মানুষের উপর তাঁর কিরকম অচিন্তনীয় একটা প্রভাব ছিল (পছন্দের মানুষের কথা মেনে নয়া বা তাকে অনুসরণ করা একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা)।

-তথ্যের সাথে অভিজ্ঞতার সম্পর্ককরন

৪নং প্রশ্নটাও ঠিক প্রশ্ন হয়েছে। এটার উত্তর দিতে হলে একজনকে জানতে হবে স্বাধীনতা দিবস কাকে বলে (তথ্য), ৭ই মার্চ কেন স্বাধীনতা দিবস না (৭ই মার্চের ভাষণ - তথ্য), ২৬শে মার্চ কেন স্বাধীনতা দিবস।

- দুটি তথ্যের মধ্যে সম্পর্ককরন।

৫নং প্রশ্নটাও সঠিক অনুধাবনমূলক প্রশ্ন কারণ এর উত্তরটা বলে দেয়া নাই। উত্তর দিতে হলে একজনকে চিন্তা করে বের করতে হবে যে একটা সরকার গঠন করে শপথ গ্রহণ করেই দায়িত্ব নিলেই পরিকল্পনা করে যুদ্ধ শুরু করা যায়। তবে পূর্বশর্ত হিসেবে অনেকে আরো অনেক কিছু বের করতে পারে তাই ‘প্রধান’ কথাটা জুড়ে দিলে প্রশ্নটা আরো সুনির্দিষ্ট হয় ।

এবার তাহলে আমরা প্রশ্নগুলো লিখে ফেলিঃ

  1. মুক্তিযুদ্ধকে কেন কেউ পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দুই টুকরো করার সংগ্রাম বলতে পারে না?
  2. কেমন করে পাকিস্তান মিলিটারী তার ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেছিল?
  3. বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন কেন পুরো দেশকে পুরোপুরি অচল করে দিতে পেরেছিল?
  4. ৭ই মার্চকে কেন স্বাধীনতা দিবস হিসেবে বিবেচনা করা হয় না?
  5. পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ শুরু করার পূর্বশর্ত কি ছিল? (প্রশ্নটি অনুধাবনের সীমা অতিক্রম করে)

এখানে একটা বিষয় কিন্তু লক্ষ্য করা খুব জরুরী। এই অনুধাবনমূলক প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটিই উত্তর দেয়ার জন্যে বিষয়টা নিজের মত করে বুঝতে হবে সত্যি। কিন্তু প্রত্যেকটা প্রশ্নের একটা জ্ঞানমূলক অংশ আছে। একজন যদি তার বিষয়বস্তু না পড়ে তাহলে কিন্তু একটা প্রশ্নও উত্তর দিতে পারবে না। যে অংশটুকু তার জানার কথা সেটা জানলেই শুধু সে প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারবে। যেমন- প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে জানতে হবে আওয়ামীলীগ নির্বাচনে প্রায় সব সিট পেয়ে দেশ শাসনের নৈতিক অধিকার পেয়েছিল বলেই তাদের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার হয়েছিল। 

২নং প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে উত্তরকারীকে জানতে হবে ১৯৭১ এর মার্চ মাসে পুরো বাংলাদেশে মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ চলছিল।

৩ নং প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু কি বলেছিলেন সেটা জানতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি ।

জ্ঞানমূলক প্রশ্ন করার সময় আমরা বলেছিলাম এই প্রশ্নগুলো সাধারণত  কি, কখন, কোথায়, কার, কে এই ধরনের প্রশ্নবোধক শব্দ দিয়ে তৈরি হয়। একইভাবে বলা যায় অনুধাবনমূলক প্রশ্নগুলো কেন, কিভাবে এধরনের প্রশ্নবোধক শব্দ দিয়ে তৈরি করা হয় ।

ধরে নিচ্ছি আমরা জ্ঞাননমূলক এবং অনুধাবনমূলক প্রশ্ন কেমন করে করতে হবে সেটা বুঝেছি। এবারে আমরা যাই প্রয়োগমূলক প্রশ্নে। জ্ঞানমূলক প্রশ্নে ছিল ১নং, অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ছিল ২ নং।

আরও স্পষ্ট করে বলা যায় অনুধাবনমূলক প্রশ্নের উত্তরে যেহেতু সব সময়ই একটা জ্ঞানমূলক অংশ থাকে তাই তার জন্যেও ১ মার্ক নির্দিষ্ট করে রাখা আছে। অর্থাৎ কেউ যদি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শুধু মাত্র মনে রাখা অংশটুকু লিখে বাকিটা লিখতে না পারে তাহলেও তাকে প্রাপ্য ১ মার্ক দিতে হবে।

 

সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করার একটা মূল কারণ কিন্তু মূল্যায়নে শৃঙ্খলা নিয়ে আসা। সৃজনশীল প্রশ্নের বড় শক্তিটি হল শিক্ষার্থীর সত্যিকার দক্ষতা যাচাই করার ক্ষমতা যা এর কাঠামোর মধ্যেই রয়েছে। শুধু প্রয়োজন সঠিকভাবে প্রশ্নটি তৈরী করা।

Tutorials

Create Question Interface

সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন

জ্ঞান মূলক প্রশ্ন আপলোড করা

সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন

অনুধাবন মূলক প্রশ্ন আপলোড করা

সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন

প্রয়োগ মূলক প্রশ্ন আপলোড করা

সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন

উদ্দীপক আপলোড

সৃজনশীল প্রশ্ন লিখন

জ্ঞানমূলক প্রশ্ন

সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন

অনুধাবন মূলক দক্ষতা

সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন

প্রয়োগমূলক দক্ষতা

সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন

উচ্চতর দক্ষতা

সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন